বিরোধী শক্তি ও ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উৎস পার্ট-১০

স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি ও ইসলাম


আওয়ামী লীগের ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীর অন্তরালেই স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ লুকায়িত থাকলেও ৬ দফার প্রণেতারা এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এক জিনিস নয়। ৬ দফার অভ্যন্তরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সুর ছিল নেহায়েতই প্রচ্ছন্ন এবং আন্দোলনের ধাপে ধাপে সে লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পরিকল্পনা হয়ত বা ছিল। তবে আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কখনো স্বাধীনতার আন্দোলন হিসেবে সচেতনভাবে মনে করেনি, কিন্তু দেশের সংগ্রামমুখর জনগণ ৬ দফার আন্দোলনকে ১ দফার আন্দলন হিসেবেই যে গণ্য করত এ কথা সত্য। 

জনগণের কাছে স্বায়ত্বশাসনের দাবীটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করার দাবী হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। পাকিস্তানী শাসক-শোষকের কাছেও ৬ দফা মূলত এক দফারই শামিল ছিল এবং সে কারণেই তারা ৬ দফাকে '৭০-এর নির্বাচনের পরেও মেনে নিতে চায়নি। এটা কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর নিছক অনীহাই ছিল না, এটা ছিল তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত- যার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৭০-এর সেই ভয়াল ২৫শে মার্চ রাতে। মরহুম জননেতা জনাব আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র আগেভাগেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই ১লা মার্চ তারিখেই তাঁর পল্টন ময়দানের জনসভায় জনগণের কাছে ১ দফা ঘোষণা করেছিলেন। সেই জনসভায় বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর' এই শ্লোগানটিই প্রাধান্য লাভ করেছিল। তাই পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশ হিসেবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন সচেতন বাঙালীদের মধ্যে অবশ্যই বিরাজ করছিল।

 তবে সেই স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা কি হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধ্যান-ধারণা তাদের মধ্যে ছিল না। জনাব সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সচেতন ক্ষুদ্র একটি অংশ বিশেষ বামপন্থী সংগঠনসমূহের চিন্তা চেতনায় পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে স্থির ছিল সে কথা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। স্বাধীনতা অর্জনের পরে উক্ত চেতনাকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে জাতির উপর আরোপিত করা হয়েছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক, সামাজিক শক্তিসমূহ এবং সংগ্রামী জনগণ উক্ত চেতনা সম্পর্কে মোটেও ওয়াকিফহাল ছিল না। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ কিংবা প্রতিক্রিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিল না বলে মুষ্টিমেয় লোকের চেতনাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে পরিচিত এবং গ্রহণ করানোর সকল প্রয়াসই আজ নিষ্ফল রূপ ধারণ করছে। সঠিক এবং আদর্শিক চেতনাহীন '৭১-এর যুদ্ধটিই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের রূপ না লিলেও এটি যে নিঃসন্দেহে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ ধারণ করেছিল এ বিষয়টি দিবালোকের মতই উজ্জ্বল। সত্য জনগণের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার আবেগ-অনুভূতি, সত্য তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সক্রিয়তা, স্বতঃস্ফূর্ততা এবং আন্তরিকতা। এ সত্যগুলো কোন অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রের ফলে মোটেই মিথ্যা কিংবা ভুলে রূপান্তরিত হতে পারে না। 

বিদেশী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এবং সতর্কতা অবলম্বন করার অর্থ এই নয় যে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও অনুভূতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা কিংবা তা অস্বীকার করা। এই হিসেবে যারাই গরমিল করেছে তারাই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে তাদের এই ভুলের অর্থ বোধ হয় এ দাঁড়ায় না যে, তারা বাঙালী জনগণের সার্বিক স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল। তারা বাংলাদেশের জনগণের জন্য স্বাধীনতা চেয়েছে কোন বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ ব্যতীতই। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশ ভারতের হস্তক্ষেপ করাকে তারা স্বাধীনতা নয়, গোলামীরই নতুন এক রূপ হিসেবে বিবেচনা করত। স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধী বলে যারা পরিচিত তারা সকলেই কম বেশী ভারত বিরোধী হিসেবেই অধিক পরিচিত।

 এদের ভারত বিদ্বেষী মনোভাব মোন নতুন উপাদান নয়। ভারত বিভক্তির অনেক পূর্ব থেকেই 'অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস' 'মুসলিম লীগ'-এর মধ্যকার তীব্র দ্বন্দ্বের


কারণেই ঐ বিদ্বেষ-এর বীজ অঙ্কুরিত হয়ে থাকে। ইতিহাসের দীর্ঘ জটিল পথ বেয়ে বেয়ে বিদ্বেষের অঙ্কুর মহীরুহে পরিণত হয়েছে এবং আজ কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে সংঘর্ষের আনুষ্ঠানিক কোন মহড়া না চললেও উপরিউক্ত সংঘর্ষের ফলে জন্ম নেয়া ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে তা তীব্রভাবেই বিরাজমান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেই বিদ্বেষেরই একটি নতুন বিস্ফোরণ একটি নব সংস্করণ।

 বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শুরু থেকেই ভারতীয় হস্তক্ষেপ বিদ্যমান ছিল এই সন্দেহে ভারত বিদ্বেষী রাজনৈতিক দলগুলো তাই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ না হয়েও যুদ্ধ করেছে এ লক্ষ্যে যে কোন মূল্যে দেশ স্বাধীন করতে হবে। যে কোন মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতা যে নিজেদের ভোগের বাইরে চলে যেতে পারে এ ধারণা মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না। 

প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সাহায্য সহযোগিতা স্বাধীনতার রূপ ও স্বাদ পাল্টে দেয়, স্বাধীনতা বিনষ্টও করে দেয় এ সচেতনতা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও ভারতীয় চক্রের মধ্যকার ষড়যন্ত্র সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের জানারও কথা ছিল না। তারা হানাদার বাহিনীকে অত্যাচার করতে দেখেছে, অত্যাচারিত হয়েছে বলেই আত্মরক্ষার্থে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়ে পড়েছে। তাদেরকে আওয়ামী লীগ নেতারা বুঝিয়েছেন 'আগে দেশ, পরে ধর্ম', দেশ রক্ষা করতে না পারলে ধর্মও রক্ষা করা যাবে না। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ধর্ম রক্ষা করার চেয়ে দেশ রক্ষা করার বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করে।

অপরদিকে, সাধারণ জনগণও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের আসল উদ্দেশ্য জানতে সক্ষম হয়নি। তাদেরকে বুঝানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নাম করে ভারতই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে দখল করে নিতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ ভারতেরই একটি গভীর ষড়যন্ত্র মাত্র। ভারত দেশ দখল করে নিলে বাংলাদেশের মাটি থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ধর্মই যদি না থাকে তাহলে দেশ দিয়ে কি হবে। কাফির হয়ে কাফিরদের অধীনে বেঁচে থাকার চেয়ে ঈমানের সাথে লড়াই করে মুসলমান হিসেবে শাহাদাত বরণ করা অধিক শ্রেয়।

 সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ রাজাকার, আলবদর এবং আল-শামস হিসেবে অংশগ্রহণকারী সাধারণ যোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করার তুলনায় ধর্ম রক্ষা করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছে। তারা এ কথা হয়তো বুঝত না যে, নির্যাতনকারীদের পক্ষে যুদ্ধ করে ইসলাম ধর্ম রক্ষা করা যায় না। পুঁজিবাদী পাকিস্তানকে টিকিয়ে রেখে প্রগতি, শান্তি ও সাম্যের ধর্ম ইসলামকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। পুঁজিবাদের অধীনে পাকিস্তান টিকে গেলেও পুঁজিবাদের বিষবাষ্পে ইসলাম বিকৃত ও পঙ্গু রূপ ধারণ করবে।

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের সাধারণ যোদ্ধারা উভয় পক্ষের কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর কূট প্রোপাগান্ডার শিকারে পরিণত হয়েছে এবং এরই মাঝে অসহায়ভাবে বলির শিকার হয়েছে শান্তিপ্রিয় ধর্মভীরু নিরপেক্ষ জনগোষ্ঠী। উভয় পক্ষেরই সাধারণ যোদ্ধারা সহজ, সরল এবং নির্দোষ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের সাধারণ যোদ্ধাদেরকে উপরিউক্ত আলোকেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক মূল্যায়ন করা এবং তার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যকার বিভ্রান্তি দূরীভূত করার আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশ ও জাতির ঐক্য এবং ভারসাম্যপূর্ণ ভবিষ্যত রচনা করার স্বার্থেই এ ধরনের উদ্যেগ গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন।

তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন অবস্থায় উভয় পক্ষের যোদ্ধারা যা কিছুই করেছে তা করেছে স্ব স্ব প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কারণেই কেবল। বাঙালী হয়ে যারা বাঙালীর ঘরে আগুন দিয়েছে, বাঙালী মা বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতনে শরীক হয়েছে, অহেতুক হত্যাকান্ড চালিয়েছে তারা যে পক্ষেরই হোক না কেন মানবিক দিক থেকে তারা অপরাধী। অপরাধীদের কোন পক্ষ নেই।

 অপরাধীদের অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, তাদের একমাত্র পরিচয়ই হচ্ছে তারা অপরাধী। অপরাধের বিচার কাম্য- এটা নৈতিক, সামাজিক, মানবিক এবং প্রচলিত আইন প্রশাসনেরই দাবী। কোন অপরাধের বিনা বিচারে ক্ষমা প্রদর্শন একটি ক্ষমাহীন অপরাধই বটে।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রকৃত অপরাধীদের সুযোগ্য বিচারের দাবীতে বাংলাদেশের জনগণ আকুলভাবেই সোচ্চার ছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক মুরুব্বীদের চাপে দুর্বল শাসকগোষ্ঠী অসহায়ভাবেই নতি স্বীকার করেছে। তাদের এই নতি স্বীকার করার ফলে প্রকৃত অপরাধীরা হয়তো জীবনে বেঁচে গেছে কিন্তু দেশ ও জাতি রক্ষক্ষরণের হাত থেকে মোটেই নিস্তার পায়নি। তাই স্বাধীনতার ১৭ বছর পরেও স্বাধীনতা আজো তেতো, মুক্তিযুদ্ধ আজ বিকৃত এবং বিস্মৃতপ্রায়।

হানাদার পাকবাহিনী যারা দীর্ঘ ৯টি মাস ধরে বাংলাদেশের বুকে অবলীলাক্রমে গণহত্যা চালিয়ে ইতিহাসের পাতায় এক জঘন্য অধ্যায় সৃষ্টি করল, তাদেরকে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী কিসের স্বার্থে উদ্বার করে নিয়ে গেল ভারতে? সেই সকল হত্যাকারী গণদস্যুদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করা হলো না কেন? যারা মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশের দরদী সেজে বাঙালীদেরকে উদ্ধার করতে এলো তারাই বাঙালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানী হত্যাকারী বাহিনীকে নিরাপদ আশ্রয়ে উদ্ধার করে নিয়ে বাঙালী প্রেমের পরিচয় দিয়েছে না পান্জাবী প্রেমের পরিচয় দিয়েছে? মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রী বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাকারীদের প্রতি অভটা দরদী হয়ে ওঠার পেছনে কারণটা কি ছিল? রসুনের গোড়া নাকি এক জায়গায়। এ সকল মার্সিনারী আর্মির গোড়াও একই জায়গায় - আমেরিকার পেন্টাগনে। সুতরাং 'মুক্তিযুদ্ধ', 'স্বাধীনতা যুদ্ধ' 'পাক-ভারত যুদ্ধ' ও সকল কিছু না, লৌকিকতা মাত্র। সংগ্রামমুখর জনগণকে বিভ্রান্ত এবং হতাহত করে আন্তর্জাতিক মহল থেকেই বাংলাদেশে গণহত্যাকারী পাকিস্তানী নরপশুদের বিচারের দাবী শোনা যেত। না তেমন কিছুই হয়নি, হবেও না যতদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহল অভিন্তু সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত না হয়।

নির্যাতিত বাঙালীরাই কেবল বিচারের দাবীতে চিৎকার করেছে। সে চিৎকার কেউ শোনেনি। বাংলাদেশে সংঘটিত ইতিহাসের একটি নারকীয় গণহত্যা বিনা বিচারেই ধামাচাপা পড়ে রইল। অপরাধের প্রধান নায়করাই যেখানে বিনা বিচারে মুক্ত হলো, সে ক্ষেত্রে প্রধান নায়কদের স্থানীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার বাংলাদেশ সরকারের থাকে নি সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরশীল কোন সরকারই মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বিচারই করতে সক্ষম হবে না। তবে মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ আনার চেষ্টা না করে যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া প্রয়োজন। যতদিন পর্যন্ত অপরাধীদের বিচার না হবে, ততদিন পর্যন্ত জাতি দূর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকবে এবং এ কারণে বাংলাদেশের মাটিতে (স্বাধীনতা বিরোধীদের কারণেই) পবিত্র ইসলাম ধর্ম বিরোধী প্রপাগান্ডার অবসানও হয়তো ঘটবে না। স্বাধীনতা বিরোধী প্রায় সকল দল ও গোষ্ঠী যেহেতু ইসলামভিত্তিক, সেহেতু ইসলামই সমালোচনার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলামে কোন অপরাধীরই আশ্রয় থাকার কথা নয়। ইসলাম অন্যায়, অপরাধ বিরোধী এক সক্রিয় জীবন ব্যবস্থা।

ইসলাম অপরাধমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ইসলাম শোষণহীন, শ্রেণীহীন, সাম্যবাদী সমাজ কায়েম করে। ইসলাম পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, রাজতন্ত্রসহ সকল ধরণের স্বৈরশাসনের ঘোর বিরোধী। ইসলাম মুক্তি এবং শান্তির এক বিপ্লবী ঘোষণা। স্বাভাবিক কারণেই ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ চেতনার পক্ষের শক্তি। মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামে ইসলাম প্রতিবন্ধক তো

40
নয়ই, বরং যুগান্তকারী এক সহায়ক শক্তি- মূলশক্তি বললেও অত্যুক্তি হবে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহকে একমাত্র প্রভু ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসলাম মানুষকে মূলত স্বাধীন করে দিয়েছে। এই স্বাধীন মানুষের উপর একমাত্র আল্লাহর প্রভুত্ব ব্যতীত যে কোন ধরনের প্রভুত্ব চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইসলাম আপোষহীন জিহাদ ঘোষণা করে। এমন একটি জীবন দর্শন যা চূড়ান্ত অর্থেই পরিপূর্ণ, সেই সম্পর্কে যারা অসহিষ্ণু মনোভাব প্রদর্শন করে, তা ভারা অজ্ঞতাবশতই করে বলে আমার বিশ্বাস।

আর যদি কেউ সজ্ঞানেই ইসলাম বিরোধী প্রচারে লিপ্ত হয়, তা তারা করে কায়েমী স্বার্থেরই কারণে কেবল কোন পরামর্শ কিংবা সমালোচনাই তাদেরকে অপপ্রচারের কুৎসিত পথে থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয় না। তবে অপপ্রচারকারীদের অধিকাংশই যে হচ্ছেন ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞদের অন্তর্ভূক্ত সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে এই ইসলাম এলার্জী শিক্ষিত সমাজের মধ্যে একটা মানসিক ব্যাধির ন্যায় বিরাজ করছে। ইসলামের কথা শোনামাত্রই তারা বিরক্তি ও ঘৃণাভরে কতকটা ভোতাপাথীর মতনই কতিপয় শব্দ উচ্চারণ করে বসে- যেমন, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি। বিনা জ্ঞানে কিছু সম্পর্কে মন্তব্য করার স্বভাবটাই যে প্রতিক্রিয়াশীলতার লক্ষণ সে কথা তারা বেমালুম ভুলে যায়। কোন দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করতে হলেও যে সেই দর্শন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এখানে একটি কথা বলে রাখা আবশ্যক যে, ইসলামে সাম্রাজ্যবাদের রূপ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক এবং ইসলামে বিপ্লবের রূপ হচ্ছে সাম্যবাদ। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রেই আজ ইসলামে সাম্রাজ্যবাদ বিরাজ করছে। একমাত্র ইরানই হচ্ছে এর ব্যতিক্রম। বিপ্লবী গণজাগরণের মধ্য দিয়ে যেমন সাম্রাজ্যবাদকে হটিয়ে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা হয়, ঠিক তেমনি আদর্শিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ইসলামকেও সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত করতে হবে। আমাদের মত মুসলিম প্রধান দেশে ইসলামহীন স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে গণমানুষের স্বাধীনতা নয়, ঠিক তেমনি স্বাধীনতাহীন ইসলাম ও গণমানুষের ইসলাম নয়, তা থেকে যায় দরবারী ইসলাম' অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরশীল প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত ইসলাম।

যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যারা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভূত মাথায় বহন করে এনেছে তারা যেমন ভুল করেছে, ঠিক তেমনি ভুল করেছে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিসমূহ যারা ইসলামকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে গিয়ে স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করে বসেছে। তাই মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার প্রকৃত রূপ হতে হবে সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রমুক্ত ইসলাম। ইসলামহীন স্বাধীনতা অথবা সাম্রাজ্যবাদ ও রাজতন্ত্র নির্ভরশীল ইসলাম সহকারে স্বাধীনতা এর কোনটিই বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের মুক্তির পথে সহায়ক হবে না। ইসলাম ভিন্ন বাংলাদেশে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শতকরা ১০ ভাগ মানুষও ধর্মভীরু এবং তারাও ধর্ম সহকারেই স্বাধীনতা এবং মুক্তি কামনা করে। প্রকৃত ইসলামের সাম্যবাদী নীতি এবং ইসলামের ঐতিহ্যবাহী নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কোন বিরোধ তো নেই-ই বরং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিধান রয়েছে ইসলাম ধর্মে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দান ইসলাম তো করেই না, অন্যান্য ধর্মমতেও তদ্রুপ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ ছিল না, ধর্মযুদ্ধ ছিলনা। সুতরাং যুদ্ধোত্তরকালে ধর্মের প্রতি উম্মা কিংবা কটাক্ষ করার কোন যুক্তিই নেই, থাকতেও পারে না। তবুও রয়েছে কেন?

আওয়ামী লীগের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উৎস


১৯৭০ এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ৬ দফার ভিত্তিতে। এই ৬ দফার মধ্যে আওয়ামী লীগ গৃহীত ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতির একটিরও উল্লেখ ছিল না। তা ছাড়া নির্বাচনী ইশতিহারে আওয়ামী লীগ আরো উল্লেখ করেছিল যে, তারা ইসলাম ধর্ম বিরোধী কোন আইন-কানুনও পাস করবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ৭২ সনের জানুয়ারীতে ক্ষমতাসীন হওয়ার সাথে সাথেই ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে দেয় এবং গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ নামে রাষ্ট্রের ৪ মূলনীতি নির্ধারণ করে, যা পরবর্তী ৭২-এর রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও সন্নিবেশিত করা হয়। এই ৪ নীতির মূল উৎস কোথায়? কেনই বা উক্ত নীতিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জনগণ আজো পায়নি।

যে আওয়ামী লীগ '৭০-এর নির্বাচনে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন পাস না করার পক্ষে, সেই আওয়ামী লীগই ভারত থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গুটিয়ে নিয়ে এসে ক্ষমতার মসনদে বসার সাথে সাথেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করল কেন? স্বেচ্ছাচারী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্বেচ্ছাচারমুক্ত হতে পারল না। দেশের জনমতের কোনরূপ তোয়াক্কা না করেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব জনগণের উপর জবরদস্তিভাবেই চাপিয়ে দিল।

আওয়ামী লীগ শাসনকালের বিশ্বাসঘাতকতার আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর এখান থেকেই শুরু। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গেলে ৭০-এর নির্বাচনের কথায় ফিরে যেতে হয়। ৭০-এর নির্বাচন ছিল পাকিস্তান কাঠামোর আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন। আওয়ামী লীগ নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করেছিল পাকিস্তানের অধীনে। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অধীনে নয়। সুতরাং '৭২-এর আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংবিধান প্রদান নীতিগত দিক থেকে মোটেই বৈধ ছিল না। সমগ্র জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। অমন একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এখানে আরো উল্লেখযোগ্য যে, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সপক্ষে যারা ভোট প্রদান করেনি, তারাও দেশ-মাতৃকার মুক্তির লড়াইয়ে শরীক হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে শরীক হয়েছেন আওয়ামী লীগ বিরোধী অথবা আওয়ামী লীগ বহির্ভূত বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় রূপ ধারণ করেছিল।

কিন্তু যুদ্ধোত্তরকালে আওয়ামী লীগ চরম সংকীর্ণতার পরিচয় দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় রূপকে দলীয় রূপ প্রদানের জন্য বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ বহির্ভূত সকল শক্তি হতোদ্যম হয়ে পড়ে এবং তারা তাদের নবতর আশা- আকাঙ্খার বাস্তবায়ন করার সুযোগ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বঞ্চিত হয়। যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশে যখন জাতীয় ঐক্যের সর্বাধিক প্রয়োজন ছিল, ঠিক সেই সময়েই আওয়ামী লীগ একলা চলার নীতি অনুসরণ করে চলতে থাকে। এসব কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় রাতারাতি ভাটা দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের যুদ্ধকালীন দূর্নীতি এবং ব্যর্থতা এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে জনগণের উপর স্বৈরতান্ত্রিক নির্যাতন জনগণ থেকে আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্ন করার উপসর্গ সৃষ্টি করে।
বস্তুত সেই ভয়ে ভীত আওয়ামী লীগ '৭২-এ জনগণের ম্যান্ডেট নেয়ার চিন্তা থেকে বিরত থাকে। অথচ সংবিধান রচনার পূর্বেই জনগণের তরফ থেকে নতুন ম্যান্ডেট লাভ করা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। অতএব, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, '৭২-এ আওয়ামী লীগের এমন কোন বৈধ অধিকার ছিল না যাতে করে তারা দেশ ও জাতির উপর একটি মনগড়া সংবিধান আরোপ করতে পারে। তবুও তারা তা জবরদস্তি করেছে। দেশের জনগণের চিৎকার প্রতিবাদ কোন কাজেই আসেনি।

এটা তাদের দুঃসাহস কিংবা ঐদ্ধত্য ছিল না, আওয়ামী লীগের এই আচরণ ছিল অনুগত তল্পীবাহকের প্রভূর আদেশ-নির্দেশ পালন করার বাধ্যতা বা ব্যস্ততা। কারণ, এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের '৭২-এর সংবিধান প্রণেতা হচ্ছে স্বয়ং দিল্লীর শাসক চক্র। '৭২-এর সংবিধানের উৎস তাই বাংলাদেশের জনগণ নয়, সম্প্রসারণবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ভারতীয় শাসক চক্রই হচ্ছে মূল উৎস।

এভাবেই যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের কোটি কোটি বুভুক্ষু মানুষের জন্য অন্নবস্ত্রের পূর্বেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি মাথায় চেপে বসে। এই চার মূলনীতি আরোপ করার মধ্য দিয়ে দিল্লীর কর্তারা তাদের মূল লক্ষ্যই স্থির রেখেছে কেবল। কারণ ভারতীয় সংবিধানও ৪ মূলনীতির ব্যতিক্রম নয়। ভাই বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ সন্নিবেশিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে মূলত ভারতেরই একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে সূক্ষ্মভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং নীতির গোপন সূত্রে বেঁধে দেয়া হয়েছে।

কারণ এ যুগে তো আর দেশ দখল করে রেখে অঙ্গরাজ্য পরিণত করা হয় না, তথাকথিত নীতির জালে পেঁচিয়ে রাখা হয় কোন দেশকে। শক্তিশালী দেশসমূহ দুর্বল দেশ ও জাতিকে বিভিন্ন চুক্তি এবং শর্তে আবদ্ধ করে রাখে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশকে এমন কিছু দাসত্বমূলক চুক্তি এবং শর্তের মধ্যে বন্দী করে রাখা। ৭২-এর সংবিধান সেই সকল দাসত্বমূলক চুক্তির মধ্যে একটি এবং অন্যতম শর্ত।

এবার তাহলে দেখা যাক, '৭২-এর প্রণীত সংবিধানের ৪ মূলনীতি বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে কতখানি সঙ্গতিপূর্ণ। প্রথমে গণতন্ত্র। এখানে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথাই বলা হয়েছে। পশ্চিমা ধাঁচের এই 'সংসদীয় গণতন্ত্র' বাংলাদেশের বাস্তবতার মুখে কেবল অচলই নয়, স্বৈরতান্ত্রিকও বটে। ‘সংসদীয় গণতন্ত্র' পুঁজিবাদের রাজনৈতিক শ্লোগান। এই সংসদীয় গণতন্ত্র পুঁজিবাদে প্রবর্তিত আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোকে বহাল তবিয়তে টিকিয়ে রাখার মূলমন্ত্র। শোষণ-জুলুমভিত্তিক সমাজ কাঠামোই হচ্ছে পুঁজিবাদের ভিত্তি। সম্পদের ব্যক্তি মালিকানায় বিশ্বাসী পুঁজিবাদ তার চরিত্রগত শোষণ-জুলুম অব্যাহত রাখার স্বার্থে প্রবর্তন করেছে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোয় যাতে কেউ কোনরূপ অনিষ্ট সাধন না করতে পারে তার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্র একটি মোক্ষম ফাঁদ সৃষ্টি করেছে যার নাম 'সংসদীয় নির্বাচন'। সংসদীয় নির্বাচনের কাজই হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাফামোকে 'নিউ লীজ অব লাইফ' প্রদান করা, অর্থাৎ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমলাতান্ত্রিক নতুন জীবন দান করা। এভাবেই সংসদীয় গণতন্ত্র সংসদীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদভিত্তিক শাসন-জুলুমমুখী আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোকে ধারাবাহিকভাবে টিকিয়ে রাখে। অন্য কথায়, সংসদীয় গণতন্ত্র পুঁজিবাদী শোষণ-শাসনের ভিতকেই কেবল টিকিয়ে রাখেনা, উত্তরোত্তর মজবুতও করে তোলে।


এছাড়াও সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পদশালীদেরকেই আইন প্রণয়নকারী সংস্থার প্রতিনিধিত্ব অর্জনে সাহায্য করে। সংসদীয় গণতন্ত্র হচ্ছে বিত্তবানদের গণতন্ত্র, বিত্তহীনদের গণতন্ত্র নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে আইন প্রণয়নকারী সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে বিত্তবান শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের স্বার্থ এবং মরযীমাফিক নতুন নতুন আইন প্রণয়ন এবং আইন ভঙ্গেরও বেপরোয়া ক্ষমতার অধিকারী হয়। সমগ্র প্রশাসনই বিত্তবানদের অনুগত তাবেদার হয়ে তাকে। এই ধরনের সমাজ কাঠামোতে কোটি কোটি বিত্তহীন শ্রমজীবী মানুষের যেখানে কর্মসংস্থান হয় না, তারা খুঁজে পায় না এক মুঠো অন্ন, সে সমাজেই মুষ্টিমেয় বিত্তবানদের কাছে জমে ওঠে সম্পদের পাহাড় এবং দারুণ স্বচ্ছাচারিতার সাথে তারা বিভিন্ন আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস এবং অনুৎপাদক কর্মকান্ডে বেশুমার অর্থ-সম্পদ অপচয় করে বেড়ায়। সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজ্যে এ সকল বিত্তবানের জন্য আইন থাকে নীরব এবং অন্ধ। কারণ আইনের মালিকও তারা।

সংসদীয় গণতন্ত্র এমন একটি মনোহরিণী ডাইনী' যা মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং বিত্তহীনদেরকে সংসদীয় নির্বাচনের রঙিন ফানুস উড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এবং শেয়ার করার জন্য অব্যাহতভাবে প্রলুব্ধ করে বেড়ায়। কিন্তু বিত্তহীনরা আশায় আশায় নিরর্থক ঘুরতেই থাকে কেবল। মরুভূমির ক্লান্ত পথিকের ন্যায় বিত্তহীনরাও 'সংসদীয় গণতন্ত্র' নামক মরীচিকাটির পেছনে ছুটতেই থাকে। গণতন্ত্র বিত্তহীনদের কাছে ধরা দেয় না।

কোটি কোটি মানুষকে ভুখা নাঙ্গা এবং অবহেলিত রেখে পুঁজিবাদ সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজে মুষ্টিমেয় বিত্তবানের হাতে যাবতীয় সম্পদ এবং উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা কেন্দ্রীভূত করে- এটাই পুঁজিবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য, চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি রাজনৈতিক দর্শনকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রথম স্তম্ভ করার মধ্য দিয়ে জনদরদী, দেশদরদী নামে পরিচিত শেখ মুজিব এবং তার আওয়ামী লীগ কিভাবে বাংলাদেশের কোটি কোটি দুঃস্থ, শোষিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন? পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো বহাল রেখে যারা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত নির্যাতিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেন, কিংবা ওয়াদা করেন, তারা হয় অজ্ঞ না হয় তারা চরম প্রতারক।

এতো গেল আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রণীত ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রথম স্তম্ভ সম্পর্কে কিছু কথা।

এবারে ৪ মূলনীতির দ্বিতীয় স্তম্ভকে আলোচনায় আনা যেতে পারে। দ্বিতীয় স্তম্ভ হচ্ছে সমাজতন্ত্র । ভাল কথা। সমাজতন্ত্রের বিস্তারিত সংজ্ঞা দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সমাজতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিবাদ বিরোধী দর্শন। বস্তুবাদভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক দর্শন পুঁজিবাদের কবর রচনার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই করার মধ্য দিয়ে যেক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সেক্ষেত্রে একই রাষ্ট্রে পুঁজিবাদী দর্শন এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শন একই সঙ্গে কি করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্তর্ভূক্ত হতে পারে? শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের দাপটে বাঘ মহিষকে যেমন একঘাটে জল খাওয়ানোর চেষ্টা চলেছে, ঠিক তেমনি হয়তো পুঁজিবাদ - এবং বেচারা সমাজতন্ত্রকে একইভাবে একই ঘাটের জল গিলানোর অপচেষ্টা চলেছিল আর কি। 

উপরিউক্ত দু'টি দর্শনের ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন সম্পর্ক রয়েছে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, উৎপাদন যন্ত্রের ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক সম্পর্কের অধিকারী হচ্ছে পুঁজিবাদ। আর, উৎপাদনযন্ত্রের সমষ্টিগত কিংবা রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক সম্পর্কের অধিকারী হচ্ছে সমাজতন্ত্র। প্রথমটি ব্যক্তির হাতে অর্থ-সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে আর দ্বিতীয়টি সমষ্টির মধ্যে অর্থ-সম্পদ বন্টন করে এবং উৎপাদন যন্ত্রের ব্যক্তি- মালিকানার ভিত সম্পূর্ণভাবেই উপড়ে ফেলে। সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এবং বৈরী সম্পর্কের এই দু'টি দর্শনকে কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী বিশেষের জনপ্রিয়তার দাপটে বাঘ-মহিষের মতই একই ঘাটে

জল গিলানো সম্ভবই নয়। কিন্তু কেউ যদি তা সম্ভবে পরিণত করার প্রয়াসও চালায়, তাহলে অবশেষে একই ঘটনার অবতারণা ঘটবে যা মুজিবকে কেন্দ্র করে ঘটেছে ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ সনে। পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্ক ঠাট্টা-তামাশার সম্পর্ক নয়, সে সম্পর্ক হচ্ছে রক্তক্ষয়ী আপোষহীন সম্পর্ক একে অপরের নিঃশেষের মতো টিকে থাকার সম্পর্ক।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে একই সাথে পুঁজিবাদ প্রবর্তিত সংসদীয় গণতন্ত্র এবং মার্কসবাদ প্রভর্তিত সমাজতন্ত্র এই দুই বিপরীতমুখী নীতির সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব এবং তার আওয়ামী লীগ তাহলে কি লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছিল? আমার মতে তাদের দু'টি প্রধান লক্ষ্য ছিল। প্রথমত সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে রাতারাতি একটি বিত্তবান গোষ্ঠী সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সেই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত রাখা। 

আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- সংসদীয় গণতন্ত্রের অধীনে কোটি কোটি ভুখা-নাঙ্গা মানুষ এবং শিক্ষিত ও বেকার যুবক শ্রেণী ক্রমশ লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার কশাঘাতে বিদ্রোহী হয়ে উঠে যাতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার দাবীতে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ধাবিত না হতে পারে, সে জন্য কেবল প্রতারণার খাতিরেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ‘সমাজতন্ত্র'কে একটি স্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। 

এটা নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সমাজতন্ত্র দিয়ে জুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাৎক্ষণিক ফায়দা বেশ লুটে নিয়েছে পাকিস্তানী পুঁজিপতি এবং কিছু উঠতি বাঙালী পুঁজিপতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শিল্প, কল-কারখানাগুলোকে বিনা পরিকল্পনায় রাতারাতি রাষ্ট্রীয়করণ করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনসমূহ মূলত বেপরোয়া লুটতরাজ করার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেছিল। রাষ্ট্রীয়করণ করার নামে আওয়ামী লীগ ঘেঁষা ব্যক্তিকরণ ও গোষ্ঠীকরণ করা হয়েছিল।

 শিল্প-কারখানাসমূহের লুটতরাজের প্রতিযোগিতা বর্বর চেঙ্গিস হালাকু খানদেরকেও হার মানিয়েছে। শাসক কর্তৃক নিজ দেশের এবং জাতির সম্পদ বেপরোয়া লুন্ঠনের দৃশ্য জাতি এই সর্বপ্রথম প্রত্যক্ষ করল। এখানে যে বিষয়টি অত্যন্ত বিস্ময়কর তা হচ্ছে পুঁজিবাদী ভারত বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমাজতন্ত্র উপহার দেবে এমন একটু দূরাশা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব করলই বা কি করে? আদৌ কি তারা তা করেছে? না করলেও ভারত থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গুটিয়ে আনার সময় সমাজতন্ত্রের নামাবলী জড়িয়ে তো তারা এসেছে বাংলাদেশের মসনদে।

এতো রইলো রাষ্ট্রীয় মূলনীতির দ্বিতীয় স্তরের কিছু কথাবার্তা।

এবারে তৃতীয় স্তম্ভটির কিছু রহস্য উদ্ঘাটন করা যাক। আওয়ামী লীগের ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতির তৃতীয় স্তম্ভ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। গভীর ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিসম্পন্ন বাংলাদেশের জনগণের উপর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আরোপ করার বিষয়টিকে মোটেই হালকা করে দেখার কোনভাবে অবকাশ নেই। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের জনগণের গভীর ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের উপর 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ' চাপিয়ে দেয়ার মতো এতবড় একটি ভুল পদক্ষেপ নিতে গেল কোন সাহসে? ভারতেরই অনুগত তাবেদার আওয়ামী লীগ সরকারের মাথায় এতবড় একটা ভুলের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ভারত কি এভাবে আওয়ামী লীগেরই রাতারাতি ধ্বংস কামনা করেছিল? 

যদি উপরিউক্ত প্রশ্নের একটিও সঠিক না হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের জনগণের উপর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চাপিয়ে দেয়ার অন্তরালে ভারতের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল? বাংলাদেশের জনগণ কেবল ধর্মপ্রাণই নয়, এ মাটির শতকরা ৯০ ভাগেরও অধিক জনগণ পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে পবিত্র ইসলাম একটি সার্বিক জীবন সত্তা, কেবল একটি গতানুগতিক ধর্ম নয়। ইসলামভিত্তিক গড়ে ওঠা এই সার্বিক জীবনসত্তা বোধকে রক্ষা করার জন্য এদেশের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অকাতরে জীবন 


বিলিয়ে দিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। প্রতিবেশী ভারত এ ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কোন কারণই নেই। এতো কিছু অবগতির পরেও ভারত আজ্ঞাবহ আওয়ামী লীগকে বাধ্য করেছে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা বহন করতে। এর স্পষ্ট জবাব হচ্ছে ভারত মোটেই ভুল করেনি। আওয়ামী লীগের উপর ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দিয়ে ভারত আওয়ামী লীগেরও সর্বনাশ কামনা করেনি। ভারতের হিসেবে বিন্দুমাত্র ভুল নেই। আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে ভারতের প্রধান শত্রুকে ভারত চিহ্নিত করতে মোটেও ভুল করেনি। দর্শনগতভাবে মার্কসবাদভিত্তিক সমাজতন্ত্রও তাদের শত্রু, কিন্তু সে শত্রু তেমন জোরালো নয়। সে শত্রু আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে শূন্য এবং রাজনীতিগতভাবে দূর্বল। ভারথীয় পুঁজিবাদের দাপট এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা এবং নৈতিকতার জোর দিয়ে তারা সমাজতন্ত্র নামক শত্রুটিকে শ্বাসরুদ্ধ করে রাখতে সক্ষম।

কিন্তু যে শত্রুটির ভয়ে তারা প্রকম্পিত তাকে তো পুঁজিবাদ, কিংবা পৌত্তলিকতাবাদ ভিত্তিক ঠুনকো আধ্যাত্মিকতার জোরে কোনক্রমেই বশ করা যাবে না। তৌহিদবাদভিত্তিক পবিত্র ইসলামই হচ্ছে ভারতের প্রধানতম ভীতি। ইসলামের ঐতিহ্যবাহী নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি, মূল্যবোধ এবং আশ্চর্যজনক আধ্যাত্মিকতার সম্মুখে ভারত যে কোন এক সময় নিরুপায় হতে বাধ্য হবে সে তত্ব ও রহস্য আমরা অনুভব করতে সক্ষম না হলেও হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারক-বাহক ভারতীয় শাসকচক্রের মোটেও অজানা নয়। বিশাল ভারতের বিভিন্ন সংকটের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংকট হচ্ছে একটি অন্যতম প্রধান সংকট। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত নীতিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রচার করলেও ভারতীয় সমাজ জীবনের বুনোট এখনো হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিশপ্ত বর্ণবৈষম্যের প্রভাবমুক্ত মোটেও নয়। 

হিন্দু ধর্মের এই বর্ণবৈষম্য অথবা জাত ও শ্রেণী ভেদ-এর কারণে প্রায়শই ভারতের বুকে যে উদগীরণ ঘটে তা আগ্নেয়গিরির লাভার চেয়েও ধ্বংসাত্মক। এ ধরনের উদগীরণ ভারতীয় জীবনের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ছক তছনছ করে দেয়। ভারেতর ৭৫ কোটি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ভারত হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা না করে 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ' অবলম্বন করতে বাধ্য হলো কেন? কারণটা সহজ। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চাপের মুখে ভারতকে যদি ১৯৪৭ সালে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হতো তাহলে তাতে আপত্তির কিছুই থাকতো না। কিংবা ভারতে বসবাসরত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের তেমন কিছু বলারও থাকত না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজ ভাতে বরং খুশীই হতো। কিন্তু তা করা হয়নি কেবল আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য।

 কারণ ভারতের বাইরে হিন্দু কোন রাষ্ট্র নেই, তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধু হিসেবে সহজে কাউকে নীতিগতভাবে পেত না। দ্বিতীয়ত, ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হলে ভারতের আভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক সংকট তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত এবং সে কারণেই ভারত জাতীয়ভাবে থাকত বিধ্বস্ত এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হয়ে পড়তো বন্ধুহীন। এই দ্বিমুখী সংকট উত্তরণের লক্ষেই ভারত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজকে নাখোশ করেও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকেই রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য থেকেছে। ভারতীয় শাসকচক্র এ কথা ভাল করেই জানে যে, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের জাত-শ্রেণীভেদের বিষবাষ্প কেবল তথাকথিত 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ' ঘোষণার প্রলেপ দিয়ে মুছে ফেলা যাবে না। তবু তো বাহাত চক্ষুলজ্জা থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার পাওয়া গেল। দেশের অভ্যন্তরে হিন্দুধর্মের জাত-শ্রেণীভেদের অনলে দেশ ও জাতি ঝুলতে থাক, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে 'ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-এর আনুষ্ঠানিক লেবাস দিয়ে বন্ধু সন্ধানে তো কোন বেগ পেতে হবে না। ভারতের 'ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার মূল ব্যাপারটা এখানেই। তবে 'ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে ভারত যে একটি সাম্প্রদায়িক হিন্দুরাষ্ট্র এ সত্য আজ বিশ্বে এ সত্য আজ বিশ্বে কার না জানা?


এই হিন্দু-ভারত হিন্দু ধর্মের জাত-শ্রেণীভেদের বিপরীতে ইসলামী সাম্যবাদকে যমের মতই ভয় পায়। ভয় তো পাওয়ারই কথা, কারণ জাত-শ্রেণীভেদের কঠিন অভিশাপের বিরুদ্ধে নির্যাতিত মানুষ বিদ্রোহ যে একদিন করবেই তা ধ্রুব সত্য এবং ইসলামের সাম্যবাদী নীতি ভারতের নির্যাতিত মানব গোষ্ঠীকে আকস্মিকভাবেই ইসলামের পতাকাতলে সমবেত করতে পারে। বাংলাদেশের ১১ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১০ কোটিই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

তাছাড়া, বাংলাদেশে বিস্ময়কর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা নেই বলেই অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা কথনই নির্যাতিত কিংবা সামাজিকভাবে সংকটাপন্নও হচ্ছে না। তেমন একটা কিছু হলেও না হয় আধিপত্যবাদী ভারতীয় চক্র বাংলাদেশের উপর সরাসরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার একটা সুযোগ লাভ করত। তেমন তো কোন সুযোগ নেই, কিন্তু বাংলাদেশের উপর ভারতের কর্তৃত্ব কোন না কোন উপায়ে তো প্রতিষ্ঠা করতে হবেই। বাংলাদেশের উপরে সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলে সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপনের তেমন কোন প্রয়োজন পড়বে না। সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বাংলাদেশের উপর অটোম্যাটিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে যাবে। 

বাংলাদেশের মূল সংস্কৃতি হচ্ছে ইসলামভিত্তিক, কারণ ইসলামই হচ্ছে শতকরা ৯০ ভাগ জনগণের ধর্ম এবং এই ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন। ভাই ইসলাম ধর্মের গভীর আবেগ-অনুভূতির শিকর থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে বিচ্ছিন্ন করতে হলে প্রয়োজন এমন একটি দর্শন, যা মানুষকে ইসলাম ধর্মের কঠিন অনুশাসন মেনে চলার পথে নিরুৎসাহিত করে তুলবে। অপরদিকে, তরুণ-যুবক শ্রেণীকে প্রলুব্ধ করবে এক বাঁধনহারা জীবনযাপনের ফাঁদে পা দিতে। ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুপস্থিতি তরুন-যুবক শ্ৰেণীকে বেপরোয়া আরাম-আয়েশ, ভোগপূর্ণ উচ্ছৃংখল জীবন পদ্ধতির দিকে ঠেলে দিলেই তারা হয়ে পড়বে শিকড়হীন পরগাছার মতন। তাদের আবেগ-অনুভূতি সমাজের গভীরে প্রোথিত থাকবে না বলেই তারা হবে ভাসমান উচ্ছৃংখল জনগোষ্ঠী। তখন তারা আর ইসলামের ঐতিহ্যে গর্ববোধ করবে না এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের জোয়ারে গা ভাসিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। কারণ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তরুণ-যুবকদের ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে এবং ধর্মীয় অনুভূতি একেবারেই মিটিয়ে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মহীনতারই লেবাসী নাম। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে বভিরিক দনরসাংকৃতিক দৃষ্টিভগি। 

এই দৃষ্টিভत्रंি চূড়াৱভাবেই বগুকেডি এবং অধিবিদ্যাमूका এই দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় স্রষ্টা কিংবা পারলৌকিক কোন শক্তির কোন স্থান নেই, সুতরাং ধর্মেরও কোন স্থান নেই। মুসলিম তরুণ-যুবগোষ্ঠী এই নাস্তিক্যবাদী তবে প্রভাবিত হলে তারা স্বেচ্ছায়ই ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে উঠবে এবং তাহলেই ভারতীয় শাসক চক্রের গোপন স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়ে যায় অর্থাৎ বাংলাদেশের উপর ভারতীয় সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে একটি সুকৌশল ঠান্ডা যুদ্ধ। ভারত তাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ জুড়ে দিয়ে মোটেও ভুল করেনি, অথবা নিছক লক্ষহীনভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ জুড়ে দেয়নি।

এতো গেল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতির তৃতীয় স্তম্ভ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

সর্বশেষে আসে জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গ। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদ জুড়ে দেয়ার পেছনেও ইসলাম বিদ্বেষী মতলব রয়েছে। কারণ জাতীয়তাবাদও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-এর ন্যায়ই জাতিকে ধর্মবিমুখ করে তুলতে সহায়তা করে এবং ভাষা, কৃষ্টি এবং জাতীয় ঐতিহ্যভিত্তিক মনমানষিকতা গঠন করে। এহেন মনমানষিকতা মানুষকে অহেতুক অহঙ্কারী করে তোলে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ও


জাতির বিরুদ্ধে জাত্যাভিমান হিংসা-বিদ্বেষের জন্ম দেয়। এই জাত্যাভিমান ইসলামী সাম্যবাদী চেতনার পরিপন্থী। তাছাড়া বাঙালী জাতীয়তাবাদ' বাংলাদেশে বসবাসরত মুসলিম জনগণের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যগত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলনও সঠিক অর্থে ঘটায়। বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালী এবং পশ্চিম বাংলার হিন্দু বাঙালীর সাংস্কৃতিক চেতনার উৎসস্থলকে এক ও অভিন্ন করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

 দুই বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের রূপ বাহ্যত এক মনে হলেও সাংস্কৃতিক চেতনার উৎস বিপরীতমুখী। স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনার উৎস হচ্ছে 'তৌহিদবাদ', যা ইসলাম ধর্মভিত্তিক। অপরদিকে পশ্চিম বাংলার জনগণের সাংস্কৃতিক চেতনার উৎস হচ্ছে ‘পৌত্তলিকতাবাদ', যা হিন্দু ধর্মভিত্তিক। সুতরাং 'বাঙালী জাতীয়তাবাদ পশ্চিম বাংলার বাঙালী ভাই-বোনদের যতটা অনুপ্রাণিত করবে, বাংলাদেশের মুসলিম বাঙালীকে ততটা অনুপ্রাণিত করবে না। 

কারণ, 'বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক চেতনায় পৌত্তলিকতাবাদ-এর প্রভাব অধিক। এই দর্শনগত পার্থক্যের কারণে উভয় বাংলার ভাষা, খাদ্য, শোষাকসহ সংস্কৃতির বাহ্যিক দিকের একটি সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে বিরাজ করছে এক সুকঠিন প্রাচীর, যা কখনো তাদেরকে এক হতে দেবে না 'বাঙালী জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে সেই প্রাচীর ভেঙে চুরমার করা সম্ভব হবে না, তবে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে সেই প্রাচীর টপকিয়ে হয়ত ওপারের সাথে একাত্ম করা যাবে। 

কিন্তু তাতে ফল হবে বিপরীত। এপারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্ম নেবে আজন্ম অবিশ্বাস এবং রেষারেষি। ভারতীয় শাসকচক্র মূলত উভয় বাংলার মধ্যে এই স্থায়ী রেষারেষীই কামনা করে। যার ফলে সবকিছু জেনেশুনেই ভারতীয় শাসকচক্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ৪র্থ স্তম্ভ হিসেবে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে জুড়ে দিয়েছে। 

বাংলাদেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবী মুসলিম বাঙালী' এবং 'হিন্দু বাঙালী সংস্কৃতিগত পার্থক্য উপলব্ধি করতে না চাইলেও পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কিন্তু পার্থক্যটা অনেক পূর্ব থেকেই জানেন। এখানে একটা উদাহরণ দিলেই ধারণাটা পরিস্কার হবে বলে আমার বিশ্বাস। উভয়েই একই হিন্দুধর্মের লোক হওয়া সত্ত্বেও যখন উচ্চবর্ণ হিন্দু নিম্নবর্ণ হিন্দু হরিজনকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে হত্যা করে, সেই উচ্চবর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে মুসলিম বাঙালীদের গ্রহণযোগ্যতা আদৌ থাকতে পারে কি? কেন পারে না? সে উত্তর বাংলাদেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা দিতে লজ্জাবোধ করলেও পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবীরা অনেক পূর্বেই সে প্রশ্নের উত্তর যুগে যুগে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠেই দিয়েছে।

নিজেদের সত্যিকার পরিচয় প্রদান করতে যে জাতি হীনম্মন্যতার শিকার হয়, সে জাতির অস্থি- মজ্জা শুকিয়ে যেতে এক শতাব্দীর অধিক প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশের বুদ্ধীজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সত্তার সংকট এতই তীব্র রূপ ধারণ করেছে যে, আজ তারা নিজ সত্তা' প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত। এ ধরনের আচরণ মুক্তবুদ্ধি কিংবা কোন বাহাদুরীর লক্ষণ মোটেও নয়, বরং এটা হচ্ছে আত্মপরিচয় দানে হীনম্মন্যতা এবং আত্মপ্রচঞ্চনার বহিঃপ্রকাশ। পরতাছাবৃত্তি প্রগতিশীলতার লক্ষণ নয়। বাস্তবতার স্বীকৃতির মধ্যেই প্রগতি। তাই জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আমার মতামত বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী আজ এই বাস্তবতারই স্বীকৃতি চায়- কারো কোন করুণা ভিক্ষা করে না। সংক্ষেপে রাষ্ট্রীয় চার নীতির 'পোস্ট মর্টেম' এখানেই শেষ।

আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রণীত বাংলাদেশের '৭২-এর সংবিধানকে যারা দেশ ও জাতির জন্য পবিত্র আমানত বলে মনে করেন, তাদের কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার সবিনয় আশ্বাসবাণী দেশ ও জাতির জন্য আপনারা ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় শাসকচক্রের তরফ থেকে যে সকল পবিত্র আমানত (!) ১৯৭১ সন থেকে বহন করে নিয়ে এসেছেন, তার মালিকানা নিয়ে আপনাদের সাথে বাংলাদেশের তৌহিদী জনগণের কোনদিনই প্রতিযোগিতা হবে না। তবে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ৪

বিশিষ্ট ইমারতটির উপর যে একটি নির্ভরশীল এবং স্থায়ী ছাড় নির্মানের প্রয়োজন ছিল, সে বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কার উপর ছেড়ে দিয়েছিল- ভারত না রাশিয়ার উপর?

জনমত এ বিষয়ে বিভ্রান্ত। ছাদহীন স্তম্ভের উপরে আধিপত্য বিস্তারের উন্মাদশক্তি মাত্রই ছাদ বিছাতে আগ্রহী থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। হলোও তাই, হচ্ছেও ভাই এবং হবেও তাই। আর তাই তো কখনো ভারত, কখনো রাশিয়া এবং কখনো আমেরিকার ইচ্ছামাফিক লীলাখেলা চলছে আমাদের ৪টি স্তম্ভের অভ্যন্তরে।

একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অবুঝের মত কেবল ৪টি স্তম্ভই ধার করলাম, নিরাপদ একটি বাসগৃহ তৈরী করার প্রস্তুতি নিলাম না।

দেশের কোটি কোটি নির্যাতিত মানুষ এবং তৌহিদী জনগণ আজ সেই নিরাপদ একটি বাসগৃহই কামনা করে, বিদেশী প্রভূদের কাছ থেকে পাওয়া স্তম্ভবিশিষ্ট ইমারত নয়।

নবীনতর পূর্বতন